আশ্রয়

আলী হোসেন

সেদিনের কথাগুলো ভাবতে বসলে মায়ার চোখ দুটো ভিজে যায়। সবে সুখের মুখ দেখেছে ওরা। প্রচণ্ড দুর্দিনেও যারা মাটির টানকে উপেক্ষা করতে পারে নি, অসময়টা যখন কাটতে চলেছে, ঠিক তখনই শিকড়টা গেল কেটে। যেন প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাস থেমে যাওয়ার মুখেই লাটাই থেকে সুতটা ছিড়ে গেল। সুত-কাটা ঘুড়ির মত পাক খেতে খেতে দশ-পুরুষের ভিটে ছেড়ে এসে পড়ল কলকাতায়; কংক্রিটের জঙ্গলে। যারা ভরসা দিল, ‘পথের শেষ কোথায়’ দেখাবে, তারা কেমন সরে গেল সেই পথেই কাটা রেখে। পরেশের কথায়, ‘না রিফিউজি হলাম, না পেলাম নিজের জমি-জিরেত বিকিয়ে কেনা জমির দখল’। তাই চোখের কোন থেকে জলের ক্ষরণ কমে গেলেও বুকের ভেতরের রক্তক্ষরণ এখনও থামেনি মায়ার।

তবে এ ক্ষরণে ভাঁটা পড়েছিল একবার। নয় নয় করে সেও বছর পনের আগের কথা। পরেশ তখন ফুটপাতের সব্জিওয়ালা, রতন ক্লাস ফোর-এ।
‘একখান কথা কইবো’?
পরেশ চোখ তোলে। চোখে চোখ রেখে ঘাড় নাড়ে; তার মানে, ‘বলুন’।
‘আপনে কি নতুন বাংলাদেশ থিকা আইছেন’?
পরেশ এবারও ঘাড় নাড়ে, মানে, ‘হ্যাঁ’।
তোমার লগে কতা কইয়া, চাল-চলন দেইখ্যা তো লেহাপড়া জানা মনে অইতাছে।
আজ্ঞে, ইন্টারমিডিয়েট পাস।
চাকরি কোরবা?
পরেশ মাথা নামায়। সাজানো সবজিতে জল ছিটিয়ে সতেজ করার চেষ্টা করে। অবিশ্বাসের ঝোড়ো হাওয়ায় অনেক বার তার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। তাই বুকের ভেতরে তেমন কোন ওঠাপড়া অনুভব করে না।
মায়ার মনে আছে, যাকে বিশ্বাস করার কোন কারণই ছিল না, সে-ই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। প্রথম প্রথম মনে হত, শালার কোন ধাঁন্দা আছে। কিন্তু ভুল ভাঙতে সময় লাগে নি। পাঁচ বছর টালিগঞ্জ ট্রামডিপোয় অস্থায়ী কর্মী হিসাবে কাজ; তারপর স্থায়ী।

আসলে জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। কি বুঝে, কোন কারণে বাদলদা সেদিন পরেশের পাশে এসে দাড়িয়েছিল, মৃত্যুর আগেরদিন পুর্যন্ত পরেশ জানতে পারে নি। শুধু বাদল নয়, আরও একজনের কথা রতনের মা এখন ভুলতে পারছে না। সে দিলদার ভাই। নামের সাথে মানুষের চরিত্রের এমন সাযুজ্য দ্বিতীয়বার দেখে নি মায়া। মায়া অবাক হয়ে ভাবে, এদেরই জাত-ভাই ক্যামনে তার দিদিরে তুইল্যা......!
মনে হলে এখনও গা শিউরে ওঠে! যেদিন রক্তাক্ত দেহটা পাঁজাকোলা করে টালির ঘরের একচিলতে বারান্দায় এনে রেখেছিল দিলদার, সেদিনও ষড়যন্ত্র ছাড়া অন্য কোন গন্ধ তার নাকে লাগে নি। মুহূর্তে সেই নেকড়ের মুখটাই ভেসে উঠেছিল মায়ার সামনে। বুকের আড়ালে জমে থাকা ক্ষোভ উগরে দিয়েছিল মায়া, ‘মুসলমান জাতটাই হইলো গিয়া ধর্ষকের জাত, বিশ্বাসঘাতক। আমার দিদিরে খাইছিস তোরা, এবার আমারে খাইবি তাই না? তোগো জন্যে দেশ ছাড়ছি। অথচ আজও আমাগো পিছন ছাড়োস নাই তোরা!’
দিলদার কথা হারিয়ে ফেলে। কিভাবে ব্যাখ্যা দেবে এ মৃত্যুর? কিভাবে বলবে, পরেশ কেন নেই! বললেই কি মায়া বিশ্বাস করবে? অবিশ্বাসের কালো ধোঁয়ায় মায়া অন্ধ। এ অন্ধত্বের আগুন এক সময় দিলদারকেও পুড়িয়ে মেরেছে। চোখের সামনে একের পর এক বাড়ি জ্বলতে দেখেছে সে। তবু মনের জোর হারায় নি দিলদার। মুসলিম মহল্লার শ্লোগান শুনে মনের জোর বাড়াবার চেষ্টা করেছে, ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্থান, লেটকে ভাঙবো হিদুর ঠ্যাঙ’। কিন্তু হাবিব মিঞাকে যেদিন জলন্ত্ব ধানের গাঁদায় ছঁড়ে ফেলে দিয়েছিল দাঙ্গাবাজরা, দিলদার আর বুকের সাহসকে ধরে রাখতে পারে নি। সেদিন সেও অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অবিশ্বাসের পষাণ বুকে নিয়ে, প্রথমে নতুন হাট, তারপর সোজা বাংলাদেশ। ভেবেছিল জাত-ভাইয়ের দেশে গিয়ে শান্তির আশ্রয় পেয়ে যাবে।
বিনিময় করে তিন বিঘা জমি পেয়েছিল দিলদার। পৌছে দেখে জমি বেদখল। দিলদার এই প্রথম অনুভব করলো অর্থ জাত-কানা। দেশ-ভাগ যে কোন সমাধান-সূত্র নয়, দিলদার হাড়ে হাড়ে টের পেল। যেদিন ভেদ বমি করে প্রথমে বৌটা, পরে ছেলেটা জগতের মায়া ত্যাগ করলো, দিলদারের অন্ধত্ব ঘুচে গেল। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এত বড় বিপদের দিনে যে পরিচিত জনেরা যে হাত বাড়াবে না, দিলদার স্বপ্নেও ভাবে নি। অগত্যা মায়ের কোলে ফিরে আসা। সেদিন পরেশ জায়গা না দিলে ফুটপাতই ঠিকানা হত তার। তাই পরেশ বড় ভাইয়ের বাড়া। আর রতন ছেলের মত।
মায়ার মনে আছে, দিলদার কিভাবে গাল্ভরে ‘মায়া ভাবি’ বলে ডাকতেন। যেন রক্তের সম্পর্ক। ছেলের জন্য মুড়কির মোয়া, দিলখুস, আর রংবাহারি খাবার নিয়ে আসতেন প্রায়ই । রতনদের ঘরের দক্ষিণ দেওয়ালের সঙ্গে একচালা এসবেস্টাসের ছাউনি। সেখানেই থাকতো দিলদার। সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হাঁক পাড়তো, ‘বাপ রতন, আমার শুকু’।
রতন বারান্দায় থাকলে হাত বাড়িয়ে দিত।
‘তুই খেলেই আমার বুকটা ভরে যায় রে বাপ। তুই-ই তো আমার শুকুর! আমার বুকের ধন’।
মায়া আবশ্য ভালো চোখে দেখে নি কোন দিন। তার মনে হত, কোন মতলব রয়েছে লোকটার। রতনকে অনেকবার সাবধান করেছে। ছেলে ধরা বলে ভয়ও দেখিয়েছে। রতন কখনও ভয় পেয়েছে, আবার কখনও পায় নি। কেন ভয় পাবে সে? জুতসই কোন উত্তর খুজে পায় নি রতন। আজ তাই প্রশ্নটা করেই বসে, তুমি কি কাকুকে ভয় পাও মা?
পাই তো।
কেন?
ও তুই বুঝবি না। মনে মনে ভাবে, আমিই যহন বুইঝা উঠতে পারি না, তহন তুই বুঝবি ক্যামনে!
বলেই দেখ না।
মায়া ধমক দেয়। দিলদার মুসলমান তুই জানোস না?
ভয়ের সঙ্গে মুসলমানের কি সম্পর্ক মা? মুখফুটে এ প্রশ্ন করার সাহস দেখায় নি রতন। কিন্তু মায়া বুঝতে পারে প্রশ্নটা বড়ই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে রতনের চোখ-মুখের চাহনিতে। তাই আবারও ধমক দেয় মায়া, বললাম তো বুঝবি না।
কি বুঝবে না ভাবি? দিলদার বাজারের থলিটা বারান্দায় রাখতে রাখতে প্রশ্ন করে।
দিলদার জানে, সে উত্তর পাবে না। পরেশের মৃত্যুর পর থেকে আজ পর্যন্ত, কোন দিনই কোন প্রশ্নের উত্তর পায় নি দিলদার। বাজার করা থেকে ওসুধ কেনা, সব কাজই কাগছে লিখে, অথবা রতনকে মাধ্যম করে হয়।
ইদানিং মায়ার খুব ইচ্ছা করছে, রতনের মত সেও ভয়কে উপেক্ষা করে, দিলদারের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলে; বুকের ভেতর জমে থাকা বদ-রক্তটা বের করে দেয়। দিলদারের পায়ের শব্দ শুনেই বাইরে এসেছিল, সে-তো সে-কারনেই। কিন্তু রতনের প্রশ্নটাই সব ঘেটে দিল। বুকের ভিতরে একটু একটু করে জমে ওঠা সাহস এক লহমায় নিঃশ্বেষ হয়ে গেল যেন।
মায়া উত্তর না দিয়েই থলিটা টেনে নেয়।
পরদিন সকাল থেকেই দিলদারকে দ্যাখে নি মায়া। আপদটা বুঝি এত দিনে বিদায় নিল। একটা বড় করে স্বস্থির নিঃশ্বাষ ফেলে মায়া। কিন্তু বেলা যত গড়িয়েছে, ততই বুকের ভেতরটা যেন ভারি হতে থাকে মায়ার। এমন তো কোনদিন হয় নি। পরেশ নেই, সে-তো অনেক দিন হল। বুকের ভিতরটা এতটা ফাঁকা লাগে নি তো কোনদিন। এতটা ভারিও মনে হয়েছে কখনও? না, মনে পড়ছে না মায়ার। সন্ধ্যারতির সময় ঠাকুরকে ডেকেছে একমনে, অনেকক্ষণ। এপাপ থেকে বেরোবার পথ বলে দাও ঠাকুর। মনটাকে শক্ত করার শক্তি দাও। একজন ভিন জাতের মানুষের জন্য মনের এমন ওঠাপড়া কি পাপ নয় ঠাকুর? ভাবতে ভাবতে চোখের পাতা যখন জুড়ে গেল, মায়া তখন মায়ার রাজ্যে। সেখানে সমাজের শাসন নেই। বিবেকের তাড়না? তাও নেই। ফুরফুরে দখিনা বাতাসে মনের একদলা পাপ ধুয়ে মুছে ছাপ। মায়ার সামনে এখন খোলা আকাশ। সে আকাশে সূর্য আছে, আছে চাঁদও। একের অনুপস্থিতির অভাব পূর্ন করে অন্যে। মায়ার আকাশে যখন সূর্য ছিল, বুক ভরে সে সূর্যের উষ্ণতা নিয়েছে। দিনান্তে যখন সে ঘুমের দেশে, চাঁদ এসে ধবল জ্যোৎনায় ভরে দিয়েছে দেহমন। তাই তাকে ভুলে থাকবে কি করে? মায়া পারছে না। পারছে না অসুস্থ মানুষের কাতর ডাককে উপেক্ষা করতে, একটু জল দেবে শুকুরের মা? একটু জল? মায়া ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ে। সে স্পষ্ট শুনতে পায় পরেশের গলা। আমাকে একটু জল দেবে মায়া? মায়া ঘুম জড়ানো চোখ নিয়ে ছুটে যায়। জল নিয়ে। একি! দেহ তো পুইড়া যাইতাছে! পরম যত্নে জলপট্টি দেয় কপালে। একটু একটু করে নেমে যায় শরীরের তাপ। নিজের বিছানায় এলে পাশ ফিরে রতন মাকে জড়িয়ে ধরে, ‘আজ তোমার ভয় করলো না মা’?
ছেলের প্রশ্ন শুনে মায়া ডুকরে কেঁদে ওঠে। আমি আর পারতেছি না রে বাবা। তর কাকুরে চইল্যা যাইতে ক’। নাইলে আমারেই আত্মঘাতি হইতে হইবো, এই তরে কইয়া দিলাম।
পরদিন সকালে সত্যিই আর দেখা যায় নি দিলদারকে।

মায়ার অম্বলের ব্যাথাটাও দিন কে দিন বেড়ে চলেছে। পঞ্চাশ পয়সার রান্ট্যাক আর কাজ করছে না। রতনটাও নাছোড়। জমিটা সে এবার বেচবেই। কিন্তু শহরের কংক্রিটের পাঁজরের এককোনে যে জায়গা পেয়েছে মায়া, তার আগল কেটে সে বেরবে কী করে? চোখের সামনে ছোট-খাট বাড়ি-ঘরগুলোর কেমন খোলস পালটে যেতে দেখেছে সে। কবে কবে শহরের নিশ্বাসের উষ্ণতা বেড়ে গেছে, খাটো হয়ে গেছে মাথার ওপরের আকাশটাও। চারিদিকের আকাশছোঁয়া সৌধের আওতায় মায়ার জীবনের বাড়টাই যেন বন্ধ হয়ে গেছে কবে। তবুও মন চায় না, শিকড় কেটে যেতে; দ্বিতীয়বার দেশান্তরি হতে।
সোনারপুর কি দেশান্তর হল মা!
নয় তো কি? সেখানে কে আছে আমার? হাঁড়-পাঁজর বের হওয়া ঠাকুর ঘরের দিকে তাকিয়ে বলে, এই বয়সে মা’কে ছাইড়া কোত্থাও যামু না, এই ত’রে কইয়া দিলাম।
রতনের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। শালা কপালটাই খারাপ। চোখ না ফুটতেই বাপটা ফুটে গেল। একদিন দিলদার কাকুও। মা’টা যে কেন কাকুকে দেখতে পারত না! মাঝে মাঝে মায়ের উপর ভারি অভিমান হয়। কাকু থাকলে তার স্বপ্নটা এভাবে ভেঙে যেত না; এখনও বিশ্বাস করে রতন।
রতন প্রতিজ্ঞা করেছে, এবারের স্বপ্নটাকে সে সার্থক করে তুলবেই। তাতে যদি.........।
ঠিকই সিদ্ধান্ত লিয়েছেন রাতোন বাবু। আপকো ভি স্বপ্না পূরাণ হোবে, আউর হামারি ভি।
কিন্তু মা যদি......।
কোন কিন্তুক নয় রাতন বাবু, মাকে বুঝানোর দায়িত্ব ভি হামি লিব। হিন্দি মেশানো ভাঙা বাংলায় পি আগরওয়াল; মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীর ম্যানেজিং ডিরেক্টর।
না না, ওটা আমিই দেখছি। আমাকে একটু সময় দিন।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। তারাহুরার কুছু নাই আমার। গলা নামিয়ে বলে, তারাহুরার পারিনাম যে ভালো হোয় না, তা হামি ভালোই জানে। না হোলে এতদিন কোবে...... মুখফুটে যেটা বললো না, ইঙ্গলিশ মিডিয়াম স্কুলটা এতোদিন কোবে ডানা মেলে দিত।
ঠিক তাই। তাড়াহুড়ো করে কিছু করলে কোন কাজ ঠিকঠাক হয়ে ওঠে না। কিন্তু এত সহজেই মা রাজি হয়ে যাবে, ভাবতেই পারে নি রতন। সে এও ভাবতে পারছে না, তার সন্তান স্কুলে পড়তে পারবে, তার মত টাকার অভাবে মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিতে হবে না! শহরতলীর কোন এক জায়গায় নিশ্চয় মাথা গোজার জায়গা সে করে নিতে পারবে। কারন, জমির দামটা সে ভালোই পাচ্ছে।
যাক, ভালোয় ভালোয় কাজটা মিটে গেল, এটাই শান্তি। রতন স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে, ‘মা, জমির কাগজগুলো দাও তো, জেরক্স করে আনি। আগরওয়ালজীকে দিতে হবে’।
মায়া ঘরে ঢোকে, রোজকার মত। কিন্তু আজকের ঢোকাটা একটু অন্য রকম। চীরদিনের মত বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে ঢোকা। আড়ে-দীঘে দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘর। দেওয়ালের প্লাস্টার খসে পড়ায় বোঝা যাচ্ছে ইটগুলো সুরকি দিয়ে গাঁথা। দক্ষিণ দিকের দেওয়াল ঘেষা দুটো চৌকি। পাশাপাশি লাগান। চৌকির ধার বরাবর ঠিক নিচে খসে পড়া সুরকির গুড়ো দেওয়ালের কোল বরাবর লম্বালম্বি পড়ে আছে। রঙচটা টিনের বাক্সের পিছনটা সুরকির গুড়োয় ঢেকে গেছে। হাতল ধরে টানতেই সুরকির গুড়ো সমেত পেছনটা খসে গেল। ভাগ্যিস কাগজগুলো নষ্ট হয় নি! ভাবে মায়া। ছেলেকে ডাকে, ‘এই নে রতন’।
রতন বারান্দায় বসে আছে। হাতল ভাঙা চেয়ার থেকেই হাত বাড়ায়।
কাগজগুলোর মধ্যে কোনগুলো দরকারি! বোঝা মুশকিল। তবু চেষ্টা করে রতন। ধূলো ঝেড়ে আসল চেহারা ফেরানোর আপ্রাণ চেষ্টা। আরে, এটা কী! রতনের চোখ পড়ে এক পাতার একটা চিঠিতে। একপিঠে গোটাগোটা আক্ষরে লেখা । লেখাটা খুব চেনা-চেনা মনে হচ্ছে! আগরওয়ালজির না? নিজের কাছেই প্রশ্ন করে। ঠিকই ধরেছি, ওনারই লেখা। বাবাকে।
‘পরেশ বাবু, আর মাত্র দুদিন সময় আছে আপনার হাতে। এখোনই ডিসাইট করে লিন, কি এটুকু জমির মায়া ছাড়বেন, না এতো বোড়ো পৃথিবীর!’
রতন মনে মনে ভাবে, তাই তুমি মত পাল্টালে মা? মুহূর্তে মনের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। গুলিয়ে ওঠে সারা গা।
আর এটা! রতনের চোখ পড়ে আরও এক পাতার একটা চিঠিতে। দু’পিঠে গোটাগোটা আক্ষরে লেখা । দিলদার কাকুর। লিখেছেন মাকে।
‘বৌদি, তুমি আমাকে সহ্য করতে পার না। আজ সেটা বুঝলাম। কেন? তাও আজ। ......কিন্তু ধর্ষকের কিম্বা বিশ্বাসঘাতকদের কি সত্যিই কোন ধর্ম থাকে? থাকলে, ওপার বাংলায় আমি আর এপারে আপনারা প্রতারিত হলেন কেন? যারা আমার-আপনার বিশ্বাসকে বিক্রি করে দিল, তারা কি একই ধর্মের ছিল না? ছিল। তা’লে এমন হল কেন?......আজ বুঝেছি, ধর্ম এক হলেও শ্রেণী এক ছিল না মোদের। ছিল না বলেই যে রডের বাড়িটা আমার মাথায় পড়ার কথা ছিল, মুহূর্তে তা ঘুরে গেল। ঘুরে গেল আপনার জীবনের গতিমুখও। ......তবু দোষটা আমারই। আমিই জোর করেছিলাম। ......পরিবার-পরিজনকে হারিয়ে যখন দেশে ফিরলাম, তখন আমার সবকিছু বেদখল হয়ে গেছে। এই জমিটুকুও পরেশের দখলে। পরেশ না চাইলে খোলা আকাশ আঁকড়ে বাঁচতে হত। তাই তার চেয়ে আপন আর কারও মনে হয় নি। ...... মালিকানা বদল করেছিলাম। তারই খেশারত দিল পরেশ.........আজ বাকিটুকুও ছেড়ে গেলাম। ভালো থাকবেন। ইতি, দিলদার ভাই।
রতন চোখ তোলে।
মায়ার ছানি পড়া চোখের অস্বছ্বতা আরও গাঁড় হয়, চোখের কোণ ফেটে উপচে পড়ে নোনতা জল। তার একফোটা যখন গলা বেয়ে নেমে গেল বুকের কাছে, মায়া বুঝলো এ জলের স্বাদ পাল্টে গেছে। এ বড় অম্ল-মধুর।
-------*****-------
৩০শে নভেম্বর
১২ টা. ০৪ (এ.এম)
Ali Hossain Mondal
Sampriti Appt.
Flat No. 3,
2002 Brahmapur, Badamtala,
Opp: Niva park (Ph-I),
Kolkata 700096
Phone : 9432983876


1823 words

Comments

Popular Posts